ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় বনের পাহাড় ও কৃষিজমি কেটে মাটি লুটে শতকোটি টাকার বাণিজ্য

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::  কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বির্স্তীণ জনপদে পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা জেলা প্রশাসনের কোনধরণের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে সংরক্ষিত বনের পাহাড় টিলা কেটে এবং আবাদি জমির শ্রেণী পরিবর্তনে চলছে মাটি লুটের মহোৎসব। সরকারি দলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত আছেন অথবা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এইধরণের একাধিক চক্র উন্নয়ন প্রকল্পের অজুহাতে কয়েক মাস ধরে নির্বিচারে পাহাড় কেটে এবং চাষের জমি কেটে অন্তত শতকোটি টাকার মাটি লুটে নিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশ সচেতন মহল।

অভিযোগ উঠেছে, পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলেও কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগের লোকজন যেন নীরব দর্শক। দেখার যেন কেউ নেই। এতে উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বেহাত হয়ে যাচ্ছে সরকারী বেসুমার ভূ-সম্পদ।

অপরদিকে বর্তমানে উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের পাশে বগাচতর এলাকায় প্রভাবশালী চক্র মালিকদের কাছ থেকে কিছু জমি ইজারা নিয়ে মইনুল হক ও রেজাউল করিমের নেতৃত্বে একটি চক্র শক্তিশালী স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে লুটে নিচ্ছে। তাতে আবাদি জমি শ্রেণী পরিবর্তনের কারণে পুকুরে পরিণত হচ্ছে। এই অবস্থায় মাটি লুটের আশপাশের অন্তত দুইশ একর চাষের জমি ভেঙ্গে ছড়াখালে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে চাষের জমি রক্ষা করতে চরম হিমশিম খাচ্ছেন ভুক্তভোগী জমি মালিক ও চাষীরা। পাশে ছড়াখাল থেকে মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন ফজল করিম, সজিব ও পুতুসহ অপর একটিচক্র।

স্থানীয় ভুক্তভোগী জমি মালিক আবুল কাশেম, নেজাম উদ্দিন, দেলোয়ার সওদাগর, চুন্নু মিয়া, নুরুল ইসলাম মাস্টার, মাহাবুব আলমসহ অনেকে অভিযোগ তুলেছেন, কয়েকমাস ধরে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল কয়েকজনের কাছ থেকে কিছু জমি ইজারা নিয়ে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে মাটি কেটে লুটে নিচ্ছে। শক্তিশালী স্কেভেটর দিয়ে জমি থেকে মাটি কেটে নেয়ার কারণে ওই এলাকার আবাদি জমি বর্তমানে পুকুরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থার কারণে ওই এলাকায় যেসব চাষের জমি এখনো রক্ষিত আছে, তার বেশিরভাগই ভয়াবহ ভাঙ্গনের তাণ্ডবে পড়েছে।

ভুক্তভোগী জমি মালিকরা দাবি করেন, তাদের জমির আশপাশ থেকে শক্তিশালী স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে নেয়ার কারণে বগাচতর এলাকার অন্তত দুইশ একর চাষের জমি হুমকিতে পড়েছে। তাঁরা উল্লেখিত চাষের জমি রক্ষা করতে গিয়ে বর্তমানে হিমশিম খাচ্ছেন। ভুক্তভোগী জমি মালিকরা এব্যাপারে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

জানা গেছে, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক সংলগ্ন এলাকায় বনবিভাগের পাহাড় টিলা কেটে এবং পাশের বগাচতর এলাকায় চাষের জমি কেটে মাটি লুটের ঘটনার সত্যতাও পেয়েছেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ সামসুল তাবরীজ। সর্বশেষ গত ২৯ নভেম্বর ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে পাহাড় কেটে লুটের স্থান থেকে অবৈধভাবে মাটি সরবরাহকালে দুইটি নাম্বার প্লেটবিহীন ডাম্পার গাড়িও (মিনি ট্রাক) জব্দ করেন তিনি।

বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক সংলগ্ন পাহাড় কেটে কতিপয় ভূমিদস্যু মাটি লুট করার খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালানো হয়।

এ সময় অবৈধভাবে মাটি সরবরাহ কাজে ব্যবহৃত নাম্বার প্লেট বিহীন দুইটি ডাম্পার গাড়ি (মিনি ট্রাক) জব্দ করা হয়। পরে জব্দকৃত দুইটি গাড়িকে একলাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জড়িতরা মুছলেকাও দিয়েছেন, সেখান থেকে আর মাটি কাটবেনা মর্মে।

জরিমানা দেয়ার পর আবারও উল্লেখিত বগাচতর এলাকায় পাহাড় ও চাষের জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে জানালে ইউএনও বলেন, যদি এইধরণের ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আবারও জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী প্রদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ডুলাহাজারা ইউনিয়নে নয়, নানা কৌশলে পাহাড় কাটা চলছে উপজেলার খুটাখালীর নোয়াপাড়া, গর্জনতলী, সেগুনবাগিচা, মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, বিএমচর ইউনিয়নে বিভিন্ন পাহাড়ী গ্রামে। সংশ্লিষ্ট এলাকার একাধিক প্রভাবশালী চক্র কক্সবাজার উত্তর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও উপকূলীয় বনবিভাগের মালিকানাধীন পাহাড় এবং সামাজিক বনায়নের জায়গা দখল করে ও চাষের জমি শক্তিশালী স্কেভেটর দিয়ে কেটে মাটি লুটের বাণিজ্যে মেতে উঠেছে।

সংরক্ষিত বনের পাহাড় এবং চাষের জমি কেটে প্রতিদিন শতাধিক গাড়িতে করে মাটি লুট অব্যাহত থাকলেও বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে দৃশ্যমান কোনধরণের উদ্যোগ নেয়নি। আবার উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত বেশ কিছু স্থানে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও পরবর্তীতে আবারও মাটি লুটের মহোৎসব শুরু করে অভিযুক্ত চক্রের লোকজন। এ অবস্থায় অভিযুক্তরা নিবিঘ্নে চালাচ্ছে মাটি লুটের কারবার।

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের চকরিয়া উপজেলার ফাসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, এখন আমাদের এরিয়ায় কোনধরণের পাহাড় কাটা নেই। অবশ্য আগে কয়েকটি এলাকায় পাহাড় কাটা হলেও সেই ঘটনায় ইতোমধ্যে বনবিভাগের পক্ষ থেকে চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বনের পাহাড় এবং চাষের জমি কেটে মাটি লুট এবং এব্যাপারে কেউ পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে কী না জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাজমুল হুদা বলেন, পাহাড় এবং চাষের জমি কাটার জন্য কাউকে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। যেখানে পাহাড় কাটা ও জমির শ্রেণী পরিবর্তন করার ঘটনা একটি বেআইনী কাজ, সেখানে অনুমোদন পাবে কী ভাবে।

তিনি বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় কাটা ও মাটি লুটের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিদিনই কোন না কোন উপজেলায় অভিযান পরিচালনা করছি। পাহাড় ও জমি কেটে শ্রেণী পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। #

পাঠকের মতামত: